মাঠের বুক চিড়ে যেন বয়ে গেছে রেললাইনটি । দুপাশে ফসলের সবুজ মাঠের সমারহ।দুপাশের বিস্তীর্ণ মাঠের বুকের উপর দিয়ে সাফের মত একেবেকে চলে গেছে লাকসাম টু চাঁদপুর রেললাইন।লাকসাম রেলওয়ে জংশন পেরিয়ে পশ্চিম দিকে এগুলেই ডাকাতিয়া নদি।তার উপর নির্মিত এই রেলপথের সবচেয়ে বড় ব্রিজ । ব্রিটিশ আমলের প্রস্তুত এই ব্রীজ কালের সাক্ষী হয়ে আজ ও টিকে আছে । এই ব্রীজের অনেক ইতিহাস । তবে আজকাল মানে ইদানিংকার কেউ সেসব তেমন জানেনা । জানেনা মুক্তিযোদ্ধের সময় এই ব্রীজের ওপারে কত নিরীহ বাঙ্গালীর প্রান কেড়ে নিয়েছে হানাদার পাকিস্তানীরা। পাশে মুচি বাড়ীটি আগের মতই আছে । আছে সেই চিরচেনা বাংলা মদের ভোঁটকা বিশ্রী কটু গন্ধ । লাকসাম জংশন থেকে তিন কিমি দূরে ইরুয়াইন গ্রাম । লাকসাম জেলার মধ্যে সবচেয়ে বড় গ্রাম বলা চলে। এই গ্রামে দেড় হাজারের ও বেশী লোক বাস করে। খালেক মিয়া সেই গ্রামের এক দরিদ্র দিনমজুর। রেললাইনের পাশের রাস্তা ধরে মাথায় বোঝা নিয়ে আসছে । গরমের কারনে নয় , আসলে তার পরিধানের মত জামা নাই তাই খালি শরীরে গামছা পেছিয়ে হাটছে । তার থেকে দু হাত পেছনে তার ছেলে ভুলু হাতে কেরোসিনের বোতলের রশি ধরে হাটছে । বাপের সাথে হেটে কুলিয়ে উঠতে পারছে না ভুলু । খালেক মিয়া আশেপাশের গ্রাম এবং নিজ গ্রামের গৃহস্তদের কাজকাম করে যা পায় তাতে তার সংসার কোনমতে চলে যায়। বেঁটে মানুষ খালেক মিয়া। শরীরে তেমন শক্তি নেই বলে অনেকে তাকে কাজে নিতে চায় না । যেখানে অন্য দিনমজুর রোজ পায় ৭০ টাকা খালেক সেখানে পায় মাত্র তিরিশ টাকা । খালেক এই তিরিশ টাকাতে বেশ খুশি থাকে । কিন্তু তার বউ সেটা সহ্য করতে পারেনা । তা নিয়ে দুজনের মাঝে প্রতিনিয়ত ঝগড়া হয়। কিন্তু তারপর ও রাহেলা তার স্বামীকে খুব ভালবাসে ।সেই ভালবাসার নিদর্শন হল খালেকের চার ছেলেমেয়ে। দুই মেয়ে দুই ছেলে । বড় মেয়ে সখিনার বয়স মাত্র দশ বছর । এই দশ বছরে খালেক অনেক বুড়ো হয়ে গেছে । বুড়ো হবে না তো কি হবে?নিজের খাবার মুরোদ নাই তার উপর ফি বছর সন্তান আসছে । কিভাবে সন্তানদের মুখে অন্ন তুলে দিতে হবে সেদিকে খালেকের কোন খবর নাই । গ্রামের সাস্থ্যকর্মী নাসরিন তাকে উপদেশ দিলে বলে আল্লাহ পাক একটা ব্যাবস্থা করবে।দুর্বল শরীর নিয়ে কাজ করতে এখন আর খালেকের ভাল লাগে না । কিন্তু খুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে প্রতিদিন কাজের সন্ধানে এই গ্রাম সে গ্রামে বের হয়। কেউ কোনদিন কাজ দেয় কেউ দেয়না । কোনদিন বিকালে আজকের মত বাজার থেকে কিছু কিনে নিয়ে যায় । কোনদিন খালি হাতে ফিরে ভাঙ্গা কুঁড়ে ঘরে।সেদিন নিজের কাছে অনেক খারাফ লাগে খালেকের । কিন্তু কিছু করার নেই । ছেলেমেয়ে গুলো ক্ষুধার জ্বালায় মায়ের কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করে। তখন রাহেলা সবাইকে একমুঠো করে শুকনো চাউল চিবুতে দেয়। সেই শুকনো চাউল চিবিয়ে চাপা কলের একমগ পানি খেয়ে পেটের ক্ষুধা নিয়েই শুয়ে পড়ে, মাটিতে বিছানো বাশের চাটাইয়ের উপর। তার পাশেই বাশের মাচানের উপর শুয়ে পরে ক্ষুধার্ত খালেক এবং রাহেলা। তখন এক ক্ষুধার কাছে অন্য ক্ষুধা পরাজিত হয় । খালেক কছে টেনে নেয় রাহেলাকে।রাহেলা প্রথমে সাড়া দেয়না কিন্তু একসময় শারীরিক খুধার কাছে পরাজয় মেনে নেয় খুব সহজে । ২ মির্জা বাড়ীতে অনেক বড় অনুষ্ঠান হবে, মির্জা সাহেবের মৃত্যবার্ষিকীতে।শাহালাম মির্জা অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে এসেছে , তাই বাবার মৃত্যবার্ষিকীতে এবার দুমদাম করে অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পুরু এলাকার সবাইকে খাওয়ানো হবে বিশেষ ভোজের মাধ্যমে।সকাল থেকে মাইকে সেই খবর জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে গ্রামে গঞ্জে সবখানে । পুরু সপ্তাহ জুড়ে চায়ের দোকান থেকে শুরু করে মহিলাদের অন্দর মহলে পর্যন্ত এই খবর ছড়িয়ে পড়ল।ছেলে বুড়ো সবার মুখে একই কথা মির্জার বেটা এবার সবাইকে খাওয়াবে পেট পুরে।খালেকের ছেলে ভুলু সেই কথা শুনেছে গ্রামের দোকানে। তাই চুপিচুপি মায়ের কাছে এসে বলল শুনছনি মা ।মির্জা বাড়ীতে শুক্রবারে অনেক বড় খাওন দিব। তুমি যাইবা নি মা । ও মা । ভাগ। খালি প্যানপ্যান করস কেন । তোর বাপ আইলে বইলা দেখুম ।তখন দেখা যাইব।এহন ভাগ। আচ্ছা মা । যাইতাছি।বলে ভুলু চলে গেল রাস্তার পাশে মার্বেল খেলা দেখতে।চারপাচজন মিলে গ্রামের রাস্তায় মার্বেল খেলছে।রাস্তার মাঝে ছোট একটা গর্ত করে তার সামনে একটা দাগ দেওয়া। এর অনতি দূরে আরেকটা দাগ সেখান থেকে প্রথমে সব খেলোয়াড় একটা করে মার্বেল ছুঁড়ে মারে গর্ত লক্ষ্য করে । যার মার্বেল গর্তের মাঝে পড়ে সে প্রথম তার পর দ্বিতীয় এভাবে প্রতিযোগী নির্বাচন হয়।তারপর সবাই চারটে করে মার্বেল প্রথমজনের হাতে , সে সবগুলো মার্বেল গর্ত লক্ষ্য করে ছুড়ে মারে । সেখান থেকে কেউ একজন একটি মার্বেল কে চিহ্নিত করে সেটিকে মারতে বলে। মার্বেল নিক্ষেপ কারী তার হাতের অন্য একটি মারবেল দিয়ে সেটিকে নিশানা করে । যদি নিশানা করা মার্বেলেটি নিক্ষেপ কারীর মার্বেলটি স্পর্শ করে তাহলে সবগুলো মার্বেল নিক্ষেপ কারী পেয়ে যায়।ভুলু প্রতিদিন এই খেলা দেখে কিন্তু খেলার সাহস পায়না । কারন ছয়টি মার্বেল কিনতে এক টাকা লাগে । সে একটাকা কোথায় পাবে ? ৩ বিকেলের পড়ন্ত রোদের মাঝে খালেক আসছে বাজার থেকে। হাতে একটা পুটলির মত কি যেন । হয়ত কোন খাবার বা চাল ডাল হতে পারে। মির্জা বাড়ীর দাওয়াতের কথা আজ গঞ্জে শুনে এসেছে ।আগামীকাল মির্জা বাড়ীতে যাবে ভাবছে খালেক।সেখানে কোন কাজকাম মিলে যেতে পারে। বেশ কিছুদিন ধরে খালেক চোখে ঠিকমতো দেখতে পায়না । সম্ভবত চোখে ছানি পড়েছে।ডাক্তার দেখানোর সামর্থ্য নাই খালেকের । তাই আল্লাহপাকের উপর ভরসা করা ছাড়া কোন উপায় নাই। রাতে ঘুমুতে যাবার আগে সবাই মির্জা বাড়ীর ব্যাপার নিয়ে কথা বলে । খালেক রাহেলাকে তার কাপড়টা কেঁচে রাখতে বলে সেই সাথে ছেলেমেয়দের গুলো। সিদ্ধান্ত হয় বড় মেয়ে সখিনা এবং রাহেলা বাড়ীতেই থাকবে বাকী চারজন ওরা খেতে যাবে এবং আসার সময় বাকী দুজনের জন্য খাবার নিয়ে আসবে। ৪ শুক্রবার সকালে খালেক মিয়ার ছোট দলটা পৌঁছে যায় মির্জা বাড়ীর সামনে । অনেক মানুষ , খাবারের মৌ মৌ ঘ্রান নাকে আসছে খালেক মিয়ার । খাবারের ঘ্রানে তার ছেলেমেদের মুখ চিকচিক করে উঠল খুশিতে। গরীব মিসকিন আরো অনেক মানুষ এসেছে । সবাই মনে হয় খালেক মিয়ার মতই ক্ষুধার্ত । গতরাতে শুধু একগ্লাস পানি পান করে সবাই শুয়েছিল সকালের অপেক্ষায় । কারন আজ দুদিন ধরে ঘরে কোন চাউল নাই। গরীব মিসকিনদের জন্য আলাদা খাবার ব্যাবস্থা করা হয়েছে মাঠের পাশটায়। নামীদামী লোকদের জন্য বাড়ীর সামনে রাজকীয় প্যান্ডেলের ব্যাবস্থা করা হয়েছে। সেখানে টেবিল চেয়ারের ব্যাবস্থা করা হয়েছে সুন্দর পরিপাটি করে । আর গরীব মিসকিনদের জন্য মাঠের পাশে প্যান্ডেল করা হয়েছে ছাটাই বিছিয়ে। এতে গরীব মানুষ গুলোর কোন দুঃখ নেই, শুধু খাবার ফেলেই তাদের চলবে । টেবিলে বসে বাবুদের মত না খেতে পারলে তাদের অসুবিধা নাই। একে একে মানুষের ভীড় বাড়তে থাকে । কিন্তু খাবার দেওয়ার নাম নাই । বাড়ির সামনের প্যান্ডেলে খাওয়া দাওয়া শুরু হয়ে গেছে । ভরপেট খেয়ে মানুষ গুলো তৃপ্তির ঢেকুর তুলে খালেকদের পাশ দিয়ে চলে যায়। অবশেষে বেলা তিনটায় দিকে মাঠের পাশের প্যান্ডেলে খাবার আসে । মেলামাইনের ভাড়া করা ডেকোরেশনের প্লেটে করে সাদা মোটা চাউলের ভাত আর গরম গরম গরুর মাংস আসে সকলের পাতে। তবে বাবুদের খাবারের মত অপ্রতুল মাংস এখানে নাই । সবাইকে দুই তিন পিচ করে মাংস আর সেই সাথে বুটের ডাল পরিবেশন করে খাদিমদাররা। তৃপ্তি নিয়ে ক্ষুধার্ত মানুষের দল সেই খাবার গোগ্রাসে গলাধকরন করতে লাগল সবাই। খাবার শেষ হতেই শিরনী এল সকলের পাতে। দুধ আর আতপ চাউল দিয়ে রাধা সেই শিরনী খালেক মিয়ার কাছে অমৃতের মত মনে হল। নিজের এবং ছেলে মেয়েদের খাবার থেকে পলিথিনের ব্যাগে স্ত্রী আর বড় মেয়ের জন্য কিছু খাবার এর মাঝেই পুরে নিয়েছে খালেক মিয়া সবার অগোচরে।খাবার শেষ করে বাইরে বেরিয়ে আসে খালেক মিয়া তার বাচ্চাদেরকে নিয়ে। বাইরে এসে দেখে কিছু লোক একটা জায়গায় ভীড় করে পলিথিনের ব্যাগের মাঝে কি যেন ভরছে। খালেক মিয়া সেদিকে এগিয়ে যায়। দেখে বড় একটা ছাটাইয়ের উপর বাক্সের মাঝে বাবুদের আধা খাওয়া খাবার গুলো থেকে সবাই মাংসের ঝোল মাখা চাউল এবং উচ্ছিষ্ট গুলো সযত্নে ভরছে পলিথিনের ব্যাগে।পরিবারের অন্য কোন ক্ষুধার্তের জন্য । প্রথমে খালেক ভাবে সেও কিছু নিবে কুড়িয়ে। আবার কি মনে করে যেন খালেক পিছিয়ে আসে কয়েক পা । তারপর নিজের ছেলেমেয়েদের বলে- উপরের ওই ব্যাটা কি করে ? বসে বসে আমাদের ক্ষুধা নিয়ে মজা দেখে ?আমাদের দিকে কি তার দৃষ্টি পড়ে না । আমাদের দুবেলা দুমুঠো খাবার দিতে পারে না ? যদি না পারে তাহলে আমাদের কেন সৃষ্টি করেছে ? আর সৃষ্টি করেছেতো অন্যদের অবহেলার পাত্র কেন বানিয়ে দিয়েছে ? আমরা তার সৃষ্টি হয়ে কেন অন্যের ফেলে দেওয়া এঁটো করা খাবার খাব? চল বাবারা । এর চেয়ে আমাদের শুকনো চাউল অনেক ভাল।এই বলে হনহন করে মির্জা বাড়ীর গেট পেরিয়ে চলে খালেক। পেছনে পড়ে থাকে একদল ক্ষুধার্ত মানুষের উল্লাসিত চিৎকার ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
বিন আরফান.
প্রকৃতির সাথে মিশে গেছে গল্পটি, তার সাথে হৃদয় ছুয়েছে বাস্তব কিছু করুণ চিত্রের বর্ণনা. দিন দিন আপনার হাতে যশ বৃদ্ধি পাচ্ছে. একদিন স্বপ্ন পূরণ হবে ইনশা-আল্লাহ.
M.A.HALIM
আপনার গল্প পড়ে পুরানো দিনের জেয়াফতের কথা মনে পড়ে গেল। আজকাল গ্রামাঞ্চলে জেয়াফতও কিছুটা উন্নত হয়েছে শহরের ডেকোরেশন প্রবেশ করেছে। পরিবর্তন হয়নি কেবল খালেক মিয়াদের। কবে হবে সে ও জানা নেই। ভীষণ ভালো লাগলো। আপনার জন্য শুভ কামনা রইলো।
sakil
ভাই (জোড় হস্ত ) যেহুত এটা আপনার নাম নয় . আপনার মন্তব্য আমি দারুন খুশি . সাপ লেখতে প লাগে তা ঠিক কিন্তু টাইপিং এ ভুল হয়ে গেছে . শেষ প্পারাটা গল্পের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ . আপনাদের জন্যই লিখি আপনারা ভুল ধরিয়ে দিলে আগামীতে আরো ভালো করে লিখতে পারব . আপনাকে অনেক ধন্যবাদ .
জোড় হস্ত
আপনার ভোট আপিল অংশটি পড়ে মন্তব্য করার সাহস করলাম (ইতোপূর্বে একজনের লেখায় মন্তব্য করিয়া তার মন খারাপ করে দিয়েছিলাম হা হা হা)।লেখার যেটুকু ভাল, লেখকই তা আমার চেয়ে ভাল জানেন,আমি শুধু আমার অপছন্দ টুকু জানাইঃ লেখায় ক্রমিক নাম্বার ভাল লাগেনি, আঞ্চলিকতা পরিহারে সচেষ্ট হতে হবে (প এবং ফ,খারাফ সাফের )।শেষ প্যারাটা যেন হঠাৎ করে এসে পড়ল।
কিছু মনে করেননি তো ?(ভাল লাগাটা কিন্তু বলি নাই)
প্রজ্ঞা মৌসুমী
বর্ণনাগুলো সুন্দর হয়েছে ভাই। কাহিনীর ভিন্নতা ভালো লেগেছে। আমি অবশ্য ঈশ্বরকে দোষ দিতে পারিনা। তিনি বরাবর পর্যাপ্ত দিয়ে এসেছেন;সমস্যা সৃষ্টি করেছি আমরাই; বিনিময় প্রথা ভালই চলছিল কিন্তু অর্থের আদান-প্রদান সমস্যাকে তরান্বিত করছে। তার উপর আছে মুনাফা আর সুবিধাবাদীদের অভিনব চেষ্টা। সে যাক, সব মিলিয়ে সুন্দর গল্প
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।